পারমাণবিক বিদ্যুতেরপথে বাংলাদেশ: রূপপুর কেন্দ্রের ‘প্রথম কংক্রিট ঢালাই’ আজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী
প্রকল্প গ্রহণের ৫৭ বছর পর আজ ৩০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুতের জগতে প্রবেশ করছে। রাশিয়ার সহযোগিতায় ঈশ্বরদীর রূপপুরে পদ্মা নদীর তীরে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ পারমাণবিক চুল্লি বসানোর জন্য প্রথম কংক্রিট ঢালাই কাজের (ফার্স্ট কংক্রিট পোরিং বা এফসিপি) উদ্বোধন করবেন। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের রীতি অনুযায়ী এই উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পার-মাণবিক বিদ্যুতের জগতে প্রবেশ করবে। চুক্তি অনুযায়ী এফসিপি উদ্বোধনের দিন হতে ৬৩ মাসের মধ্যে এই প্রকল্পে উত্পাদিত বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হবে।

বর্তমানে পৃথিবীর ৩১টি দেশে ৪৩৭টি পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র রয়েছে। আজকে উদ্বোধনের পর বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ৩২তম পারমাণবিক দেশ। অনুষ্ঠানে প্রকল্পের জেনারেল কন্ট্রাক্টর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি কর্পোরেশন-রসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচোভসহ রাশিয়া ও ভারত সরকারের উচ্চপদস্থরা এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি রূপপুর হাইস্কুল ও পাকশী রেলওয়ে মাঠ থেকে সরাসরি প্রজেক্টরের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনকে দেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে একটি স্মারক ডাক টিকিট উন্মোচন করা হবে বলে জানা গেছে।

গতকাল বুধবার সকালে রূপপুর প্রকল্প এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ড. ইয়াফেস ওসমান ইত্তেফাককে বলেন, পারমাণবিক শক্তি হতে উত্পাদিত বিদ্যুত্ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। যা দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরো সচল ও মজবুত করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।  এসময় তিনি আরো বলেন, এর মাধ্যমে পূরণ হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন, সফল হবে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিঞার আমরণ প্রচেষ্টা এবং বাস্তবায়িত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ভিশন-২০২১’।

প্রকল্পের পটভূমি:১৯৬০ সালে পাকিস্তান আমলে পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ১৯৬২ হতে ১৯৬৮ সালের মধ্যে পদ্মা নদীর তীরে ঈশ্বরদীর রূপপুরকে পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে দুই দফা সম্ভাব্যতা যাচাই হলেও  অর্থের যোগান না থাকায় প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সুপারিশ করে।  তত্কালীন পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. এম এ ওয়াজেদ মিঞার উপদেশনায় প্রকল্প বাস্তবায়নে মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার একশন প্লানের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আবারো প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে যায়।

২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। এর ভিত্তিতে রাশিয়ার সঙ্গে ‘সমঝোতা স্মারক’ ও ‘ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়। ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে রাশিয়ান ফেডারেশন ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে প্রকল্প নির্মাণে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

চলছে মহাকর্মযজ্ঞ: ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। উদ্বোধনের পর হতেই দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের মহাকর্মযজ্ঞ চলছে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ৫ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকার কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হয়। এরপরই শুরু হয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় বা শেষ পর্যায়ের কাজ। এই কাজের অংশ হিসেবেই আজ উদ্বোধন হচ্ছে বিদ্যুত্ প্রকল্পের মূল স্থাপনার ‘রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং (যেখানে পারমাণবিক চুল্লি বসানো হবে)’ নির্মাণ কাজ।

রাশিয়ান ও বাংলাদেশি  বিশেষজ্ঞ ও কর্মী মিলে প্রতিদিন প্রায় সহস্রাধিক মানুষ এখন দিন-রাত কাজ করে চলেছেন রূপপুরে। এখানে ভিভিইআর-১২০০ মডেলের থ্রি প্লাস জেনারেশনের রিঅ্যাক্টর বসবে। এই রিঅ্যাক্টর বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি রাশিয়ায় শুধুমাত্র একটি বিদ্যুত্ কেন্দ্রে রয়েছে। বাংলাদেশের রূপপুরে এটি দ্বিতীয় ব্যবহার হবে।

কর্মকাণ্ডে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা এ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী রাশিয়ান ইউরিক মিখাউল খোসলেভ ইত্তেফাককে বলেন, কোনো সমস্যা নেই। নিরাপত্তা নিয়েও কোনো শঙ্কা নেই। ২০২০ সালের মধ্যেই রিঅ্যাক্টর ভেসেলসহ সব যন্ত্রপাতিই রাশিয়া হতে চলে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর জানান, প্রকৌশল চুক্তি ও নির্মাণ সিডিউল অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে কাজ এগিয়ে চলছে। নির্মাণাধীন রূপপুর বিদ্যুত্ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। মূল স্থাপনার জন্য সয়েল স্টাবলিস্টমেন্টের কাজ শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের মাটি তুলনামূলক নরম হওয়ায় মেশিনের সাহায্যে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত সিমেন্ট মিশিয়ে কংক্রিট তৈরি হয়েছে। ১৭ হাজার ৪৫০ কিউবিক মিটার কংক্রিটিং করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারির মধ্যেই পুরোটা শেষ হবে। মূল স্থাপনার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে ৭০ মিটার করে, আর ফাউন্ডেশনের থিকনেস হবে ৩ মিটার। আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজও দ্রুতগতিতে চলছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথম পর্যায়ে ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। এই জমি পর্যাপ্ত না হওয়ায় ইতোমধ্যেই ৮০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া আরো ২১৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াও শেষ পর্যায়ে। পদ্মার বিশাল চরে নতুনভাবে অধিগ্রহণ করা জমিতে চলছে মাটি ভরাটের কাজ। মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে নির্মিত হচ্ছে অত্যাধুনিক আবাসন পল্লি ‘গ্রিনসিটি’। পাবনা গণপূর্ত অধিদফতর এগুলো বাস্তবায়ন করছে। তিনটি সুউচ্চ ভবনের কাজ এরমধ্যে শেষ হয়েছে। প্রকল্পে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০তলা ১১টি বিল্ডিং এবং ১৬ তলা ৮টি বিল্ডিংয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ২২টি সুউচ্চ বিল্ডিং তৈরি হবে এই চত্বরে। প্রকল্পের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মিজানুর রহমান জানান, নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে রূপপুরে।

সর্ববৃহত্ প্রকল্প: দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহত্ ব্যয়ের প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র। মোট ব্যয়ের মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে রাশিয়া ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা দিবে বলে চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভিভিইআর-১২০০ (এইএস-২০০৬) রিঅ্যাক্টরের দুটি বিদ্যুত্ ইউনিটের (ইউনিট-১ ও ২) সমন্বয়ে দুই হাজার চারশ’ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে। প্রকল্পের পরিচালক ড.শৌকত আকবর জানান, রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য রাশিয়ার মস্কোয় দক্ষ জনবল হিসেবে তৈরি হচ্ছেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। তারা সেখানে ন্যাশনাল রিসার্চ নিউক্লিয়ার ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখার পাশাপাশি হাতে-কলমে কাজ শিখছে। তিনি জানান, ২০১৪ সাল হতে গ্র্যাজুয়েট এবং আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে মোট ৪৭ জন শিক্ষার্থী সরকারের বৃত্তি গ্রহণ করে মস্কোতে নিউক্লিয়ার বিষয়ে লেখাপড়া করছে। ২০১৮ সালেই প্রথম ১২জন এমএস ডিগ্রী অর্জন করে দেশে ফিরে এই প্রকল্পে যোগদান করবে।