লাসভেগাস হত্যাকাণ্ড

গত ১লা অক্টোবর রোববার মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রের লাসভেগাসে ঘটল বন্দুকধারীর গুলিবর্ষণের ঘটনা। ৬৪ বছর বয়েসী স্টিফেন ক্রেইগ প্যাডক নামক এক মার্কিন শ্বেতাঙ্গের নির্বিচার গুলিবর্ষণের এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৯ জন। আহতের সংখ্যা ৫২৭। পুলিশের ভাষ্যমতে লাসভেগাসের  মান্দালাই বে হোটেল এ্যন্ড ক্যাসিনোতে কনসার্ট দেখতে জড়ো হওয়া ২২ হাজার মানুষের উপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি শুরু করে ঐ বন্দুকধারী। হোটেলের ৩২ তলার একটি কক্ষ থেকে সে গুলি করে যাচ্ছিল। পুলিশ পৌঁছার আগেই বন্দুকধারী অস্ত্র ঘুরিয়ে নেয় নিজের দিকে। ঐ কক্ষে পৌঁছে পুলিশ উদ্ধার করে তার গুলিবিদ্ধ লাশ। রোববার মধ্যরাতের এই হত্যাকা-কে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ‘মাস শুটিং’।

সোমবার হোয়াইট হাউস থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ঘটনাকে অভিহিত করেছেন ‘খাঁটি শয়তানি কাজ’ বলে। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, এই খাঁটি শয়তানি কাজ এখন যুক্তরাষ্ট্রে অনেকটা সাধারণ রীতি। নিয়মিত বিরতিতে তা ঘটে চলেছে। এফবিআইয়ের হিসাবে শুধু ২০১৭ সালেই স্বদেশবাসীর গুলিতে নিহত হয়েছে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ। গত বছর জুনের অরল্যান্ডো-হত্যাকা-ের পর এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৫৮৫ জন, আহত ২১৫৬ জন। (নয়া দিগন্ত, ১০ অক্টোবর, ২০১৭)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট কি পারবেন তার দেশের  ভেতরের এই শয়তানি কাজ বন্ধ করতে? তিনি তো মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তার অজুহাতে গোটা উত্তর কোরিয়াকেই ‘টোটালি ডেস্ট্রয়’ করে  দেওয়ার ঘোষণা জাতিসংঘের সকল জাতি-গোষ্ঠীর মুখের ওপর দিয়ে আসতেও দ্বিধা করেননি, কিন্তু নিজের দেশের ভেতরের এই নিরাপত্তাহীনতা তিনি রুখবেন কীভাবে?

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, স্টিফেন প্যাডক বেশ প্রস্তুুতি নিয়েই হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে। শহরটির শেরিফ জানিয়েছেন, হোটেলটির ৩২ তলার ঐ কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২৩ টি বন্দুক ও কয়েক হাজার রাউন্ড গুলি। এছাড়া তার নেভাদার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আরো ১৯ টি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক।

এই ঘটনার পর সঙ্গত কারণেই কথা উঠছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান অস্ত্র আইন নিয়ে। এই আইনে নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র রাখার অধিকার দেয়া হয়েছে।

পাঁচ বছর আগে কানেক্টিকাটের এক প্রাইমারি স্কুলে এক যুবকের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে ২৬ শিশুর মৃত্যুর পর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জোর দাবি ওঠে। গত বছর অরল্যান্ডোর নাইটক্লাবে বন্দুকধারীর গুলিতে ৪৯ জন নারী-পুরুষের নিহত হওয়ার পরও এই দাবি জোরালোভাবেই সামনে এসেছিল। এমনকি এ নিয়ে কংগ্রেস ডেমোক্রেটরা রাতভর আইনসভা কক্ষ ঘেরাও পর্যন্ত করে রেখেছিলেন। কিন্তু ফল কিছুই হয়নি। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সারা দেশের বেশির ভাগ মানুষ একমত হলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিশ্লেষকেরা বলেন, এর প্রধান কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘গান-লবি’। ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন বা এনআরএ আমেরিকার মানুষের অস্ত্র বহনের অধিকারের পক্ষে প্রধান গ্রুপ। কংগ্রেসের বিভিন্ন সদস্যকে প্রভাবিত করার জন্য এরা বছরে প্রায় ২৫ কোটি ডলার খরচ করে থাকে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষের প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য এরা সরাসরি খরচ করেছে ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। (দৈনিক প্রথম আলো, ৪ অক্টোবর, ২০১৭, পৃ. ১১)

এটা হচ্ছে পশ্চিমা পুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থার এক অন্ধকার দিক। মুখে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি যা কিছুই বলা হোক, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শান্তি ও নিরাপত্তা কার্যত শূলিবিদ্ধ পুঁজির শূলিদ-ে।১

পশ্চিমা পুঁজিবাদ গোটা পৃথিবীটাকেই বানিয়ে রেখেছে যুদ্ধক্ষেত্র। সচেতন মাহলের অজানা নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় অস্ত্র-নির্মাতা ও অস্ত্র-রফতানীকারক দেশ।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে বিশ্বের সেরা কয়েকটি অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠা ও তাদের বিক্রয়ের পরিমাণের দিকে নজর দেয়া যাক।

লকহিড মার্টিন : যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত এ অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি বিমান, রাডারব্যবস্থা, ড্রোন ও বিমান উৎপাদন করে। এদের সবচেয়ে বিখ্যাত পণ্য এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ও হারকিউলিস পরিবহন বিমান। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি তিন হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য বিক্রি করে।

বোয়িং : যাত্রীবাহী বিমান তৈরি করে খ্যাতি পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালে দুই হাজার ৮০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে মুনাফা করেছে ৫২০ কোটি ডলার। এফ-১৫, এফ-১৮, এফ-২২ যুদ্ধবিমান ও রকেট তৈরির জন্য বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটি। তাদের মোট বিক্রয়ের ২৯ শতাংশ আসে অস্ত্র খাত থেকে।

রেইথন : প্রধানত ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য অস্ত্র ও যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করে এ মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৫ সালে তাদের বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২০০ কোটি ডলার।

নরথ্রোপ গ্রুপম্যান : যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের এ প্রতিষ্ঠানটি ড্রোন, যুদ্ধবিমান ও রাডার উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। ২০১৫ সালে বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলার।

জেনারেল ডায়নামিকস : মার্কিন সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত এম-১এ আব্রামস ট্যাংক উৎপাদনকারী এ প্রতিষ্ঠানটিও ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত। ২০১৫ সালে অস্ত্র বিক্রি করেছে এক হাজার ৯০০ কোটি ডলারের।

এয়ারবাস গ্রুপ : ইউরোপভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটিও যাত্রীবাহী বিমান তৈরিতে বিখ্যাত। তবে ২০১৫ সালে এক হাজার ২৯০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে তারা, যা মোট বিক্রয়ের ১৮ শতাংশ।

ইউনাইটেড টেকনোলজিস : যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যের এই প্রতিষ্ঠানটির মোট বিক্রয়ের ১৬ শতাংশ আসে অস্ত্র থেকে, প্রতি বছর যা প্রায় এক হাজার কোটি ডলার। মার্কিন বাহিনীর ব্যবহৃত ব্ল­্যাক হক হেলিকপ্টার এদের তৈরি।

লিওনার্দো-ফিনমেকানিকা : যুদ্ধবিমান, অ্যাটাক হেলিকপ্টার, সাঁজোয়া যান তৈরি করে ইতালির এ কোম্পানিটি। ২০১৫ সালে বিক্রয়ের পরিমাণ ছিল ৯৩০ কোটি মার্কিন ডলার।

এল-৩ টেকনোলজিস : নিউ ইয়র্কভিত্তিক এ মার্কিন কোম্পানিটি মূলত গোয়েন্দা নজরদারি, যোগাযোগ ও জননিরাপত্তাবিষয়ক অস্ত্র উৎপাদন করে। ৮৮০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে ২০১৫ সালে।

এই পরিসংখ্যান সামনে রেখে চিন্তা করলে সহজেই বোঝা যায় বিশ্বব্যাপী গোলযোগ ও যুদ্ধাবস্থা কেন প্রয়োজন ও কাদের প্রয়োজন। তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও ২০০ বছর ২   আগের সেই অস্ত্র আইন এখনো বলবৎ রাখা কাদের প্রয়োজন ও কেন প্রয়োজন।

বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন নাগরিকদের মানসিক অস্থিরতা ও অপরাধপ্রবণতার যে চিত্র বিভিন্ন জরিপ ও পরিসংখ্যানে উঠে আসছে এর সাথে অস্ত্র বহনের অবাধ অধিকার নিঃসন্দেহে এক ভীতিকর ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র যে সকল বিষয়ে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে এর একটি হচ্ছে কারাবন্দীর সংখ্যা। সংখ্যাটি ২২ লাখ ৩৯ হাজার ৭৫১ জন।

হত্যাকারী স্টিফেন প্যাডক সম্পর্কে জানা গেছে তিনি একজন কোটিপতি। লাসভেগাসের উত্তর-পূর্বের মেসকাইট শহরের প্রবীণ নাগরিকদের একটি কমিউনিটিতে নিরিবিলি অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন। পরিবার-পরিজন বলতে ম্যারিলু ড্যানলি নামক এক বান্ধবীর সাথেই তিনি বসবাস করতেন। ঘটনার পর মার্কিন মিডিয়াতে তাকে উল্লেখ করা হয়েছে লোন উলফ (নিঃসঙ্গ শিকারী) বলে। কী মসৃণ খেতাব! যেখানে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে অথবা মুসলিম নামের কারো দ্বারা একটু কিছু ঘটে গেলেই ‘জঙ্গি’ ‘আত্মঘাতী’ জিগির চলতে থাকে সারা বিশে^ মাসের পর মাস, সেখানে এত বড় হত্যাকা- সংঘটনকারী কত সুন্দর খেতাবই না অর্জন করলেন।

পশ্চিমা সমাজ-ব্যবস্থায় প্রবীণ নাগরিকদের নিঃসঙ্গতাও এক ভয়াবহ ব্যাপার। তাদের কি কখনো মনে হয়েছে, এই নিঃসঙ্গতাই তাদেরকে ‘শিকারী’ করে তুলছে? নিঃসঙ্গতা মোকাবিলার জন্য পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আছে অনেক কিছুÑ মদ, জুয়া, নারী এবং বন্দুক। আলোচিত ‘নিঃসঙ্গ শিকারী’ চারটি উপায়ই ব্যবহার করেছেন।

লাসভেগাসের এই হত্যাকা-ে আরেকটি বিষয়ও আলোচিত। বিশ্লেষকেরা ক্ষোভের সাথে বলেছেন, এই নির্মম হত্যাকা-ের পরও স্টিফেন প্যাডককে ‘সন্ত্রাসী’ বলা হয়নি। মার্কিন মিডিয়ায় তাকে অভিহিত করা হচ্ছে গ্র্যান্ডড্যাড (দাদা মশায়), লোন উলফ (নিঃসঙ্গ শিকারী), জুয়ারি বা সাবেক হিসাব রক্ষক প্রভৃতি নামে। তাঁরা বলছেন, এই লোকটি যদি একজন কৃষ্ণাঙ্গ হত তাহলে অনেক আগেই তার নামের সাথে টেররিস্ট কথাটি যুক্ত হয়ে যেত। আর মুসলিম হলে তো কথাই ছিল না।

এদিকে কোনো কোনো মিডিয়ায় এই তথ্য এসেছে যে, এই হত্যাকা-ের পরপরই আইএস এর দায় স্বীকার করেছে। এমন কথাও নাকি প্রচার করা হয়েছে যে, প্যাডক একজন মুসলিম, ঘটনার কয়েক দিন আগে সে ইসলাম গ্রহণ করে!!

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফবিআই) এটাকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, আইএস-এর শক্তি কতটুকু, কারা এর অর্থ জোগানদাতাÑ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে অনেক মতবিরোধ থাকলেও বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বড় কোনো ঘটনা ঘটার পর  আইএস যখন এর দায় স্বীকার করে তখন তদন্ত কর্মকর্তারা চোখ বুজেই তা গ্রহণ করেন এবং ঢালাওভাবে মুসলমানদের অভিযুক্ত করে থাকেন, কিন্তু এবারের লাসভেগাস হত্যাকা-ের পর আইএস তার নিজস্ব সংবাদমাধ্যম ‘আমাক’-এ বিবৃতি দিয়ে দায় স্বীকারের পরও এফবিআই এটাকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেয়াতে মনে হচ্ছে, এবার হিসাব-নিকাশটা অন্যভাবে করা হচ্ছে। (দ্র. নয়া দিগন্ত, ৫ অক্টোবর, ২০১৭, পৃ. ৭)

বিশ্বজুড়ে পর্দার সামনে ও পেছনে মুসলমানদের পক্ষে ও বিপক্ষে কী কী ঘটছে তার কতটুকুরই বা আমরা খবর রাখি বা রাখতে পারি। আমাদের তো নির্ভর করতে হয় প্রধানত ইহুদী-খ্রিস্টান নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় পরিবেশিত তথ্য ও সংবাদের উপর।

যাই হোক, কথা হচ্ছিল শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ নিয়ে। বাস্তবতা হচ্ছে, মার্কিন সমাজের বর্ণবাদী প্রবণতাও তাদের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস ও অবক্ষয় বৃদ্ধির এক বড় কারণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প কি এটা উপলব্ধি করেন? গত আগস্টের ভার্জিনিয়ার কুখ্যাত ঘটনাটি কিন্তু অন্যরকম বার্তাই প্রদান করে। পাঠকের হয়ত মানে আছে, ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে একটি শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী সমাবেশের প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন একদল বর্ণবাদবিরোধী মার্কিন নাগরিক। এ সময় তাদের উপর গাড়ি উঠিয়ে দেয় এক শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী। ওই ঘটনায় একজন নিহতও হয়েছিলেন। এই হত্যাকা-ের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের নিন্দা না করায় দেশে-বিদেশে তখন সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। জাতিসঙ্ঘে বৈষম্যদূরীকরণ কমিটি (সিআইআরডি) নামে মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের যে প্যানেলটি আছে, যারা জাতিসঙ্ঘের বর্ণবৈষম্য-বিরোধী চুক্তিতে থাকা ১৭৭ টি দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখভাল করে থাকে, শার্লটসভিলের ঐ ঘটনার পর এক বিবৃতিতে বলেছিল, ‘বর্ণবাদীদের দমন করতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিকদের ব্যর্থতার কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে।’

বিবৃতিতে সিআইআরডি প্যানেলের প্রধান অ্যানাস্তামিয়া ক্রিকলি বলেছিলেন, ‘শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী, নব্য-নাৎসি ও ক্লু ক্লাকস ক্ল্যানের বর্ণবাদী বিক্ষোভ-শ্লোগানে আমরা উদ্বিগ্ন, যা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদকে উসকে দেয়, জাতিগত বৈষম্য ও ঘৃণার বিস্তার ঘটায়।’

মার্কিন জাতির এই অবক্ষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের সহমর্মী হওয়ার পাশাপাশি আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি আমাদের দ্বীনকে, যে দ্বীনের উদার মানবিক শিক্ষা আমাদের মুক্ত রেখেছে এই অন্ধকার থেকে। যে দ্বীনের অনুসারী হওয়ার কারণেই আমরা হযরত বেলাল হাবাশী রা.-কে আমাদের অন্যতম আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণ করেও গর্ববোধ করি এবং তাঁর নামে আপন সন্তানের নাম রাখাকে সৌভাগ্য মনে করি। সকল প্রশংসা আল্লাহর।

ইসলাম সেই চৌদ্দশ বছর আগেই আমাদের দান করেছে ঐ প্রাগ্রসর শিক্ষা, যে পর্যন্ত বিশ্বের ‘আধুনিক’ জাতিগুলো এখনও পৌঁছুতে পারেনি। ইসলামের এই শিক্ষা এবং মুসলিম সমাজের সাম্য ও উদারতার এই বৈশিষ্ট্য-বর্ণনা করে ড. ইকবাল বলেনÑ

نہ افغانیم و نے ترک و تتاریم

چمن زادیم وازیک شاخساریم

تمیز رنگ وبوبرما حرامست

کہ ما پروردۂ یک نوبہاریم

অর্থাৎ আফগানি, তুর্কি, তাতারি কোনো প্রকারের জাতীয়তায় আমরা বিশ^াসী নই। কারণ সকল মানুষ এক মানব-বাগানেরই বিচিত্র ফুল এবং সকলেই বাবা আদমের সন্তান। আমাদের মুসলমানদের জন্য তো বর্ণবাদ সম্পূর্ণ হারাম। কারণ আমাদের চেতনা ও বিশ^াস গঠিত হয়েছে এক নতুন বসন্ত ইসলামের উদার শিক্ষায়।

ইসলামের এই উদার মানবিক শিক্ষার যুক্তি ও যথার্থতা এক আরব কবির পংক্তিতে বাঙ্ময় হয়েছে এভাবেÑ

ليس يزري السوادُ بالرجلِ الشهم

ولا بالفتى الأديبِ الأريبِ

إن يكن للسواد فيك نصيبٌ

فبياضُ الأخلاقِ منكَ نصيبي

অর্থাৎ গুণ ও যোগ্যতার শুভ্রতাই বড় শুভ্রতা আর চিন্তা-চেতনার কৃষ্ণতাই প্রকৃত কৃষ্ণতা। কাজেই মেধা, মনন ও চরিত্র-সুষমা যে অর্জন করেছে তার গায়ের কালো রং দোষের হতে পারে না। আর এ কারণেই তোমার গাত্র বর্ণ-নয়, আমি গুণগ্রাহী তোমার চারিত্রিক শুভ্রতার।

আসলে বর্ণবাদই হচ্ছে এক ঘোর কৃষ্ণতা। এই কৃষ্ণতা থেকে যে মুক্ত সবাই তার শুভ্র উদার ব্যবহার লাভ করবে। কোনো কৃষ্ণ বর্ণের মানুষও তার সংকীর্ণ আচরণের শিকার হবে না। যদি হয় বুঝতে হবে তার ভেতরটা কৃষ্ণতামুক্ত। কাজেই ঐ কালো বর্ণের মানুষটির কৃষ্ণতার উপর নয়, তার মাতম করা উচিত নিজের ভেতরের কৃষ্ণতার উপর।

দেখুন, পশ্চিমারা বিশ্বব্যাপী, বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে বিভেদ-বিভক্তির যে কূটচাল অব্যাহত রেখেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে মুসলিম জনপদগুলোতে যে আগুন প্রজ্জ্বালিত করেছে এ আগুন তাদের জনপদেও ছড়িয়ে পড়েছে দাবানলের মতো। আসলে অগ্নি থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গই ঝরে, ফুল ঝরে না। প্রশ্ন হচ্ছে, নিজেদের প্রজ্জ্বালিত এই আগুন থেকে মার্কিনীদের কে রক্ষা করবে।