আমাদের রাজ্য শাসন-২০

হযরত আলী রা.

হযরত উসমান রা.-এর শাহাদতের পর সাহাবীগণ হযরত আলী রা.-কে খলীফা নিযুক্ত করেন। সে সময় মদীনায় বিদ্রোহীদের একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। তাদের প্রতিহত করার কেউ ছিল না। এরাও হযরত আলী রা.-এর সাথে যোগ দেয়। কিন্তু তাদেরকে বের করে দেওয়ার শক্তি তাঁর ছিল না। ফলে তিনি তাদের ব্যাপারে নীরব থাকলেন।

খেলাফত লাভের পর হযরত আলী রা. কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। লোকেরা তাঁর কাছে হযরত উসমান রা.-এর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করত। হযরত আলী রা.-এরও এমনটি ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা চারপাশে এমনভাবে ছড়িয়ে ছিল যে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা তো দূরের কথা, মুখে কিছু বলাও কঠিন ছিল। তাই তিনি তাদেরকে বোঝাতে লাগলেন, একটু অপেক্ষা কর। অবস্থার একটু পরিবর্তন হলেই বিদ্রোহীদের দেখে নেওয়া হবে। কিন্তু কিছু মানুষ আলী রা.-এর অপারগতা বুঝল না বা বুঝতেই চাইল না। ফলে তাদের পিড়াপিড়ি ধীরে ধীরে বাড়তেই লাগল। আর হত্যাকারীরা যেহেতু আলী রা.-এর দলে যোগ দিয়েছে এজন্য কেউ কেউ এই ধারণা করতে লাগল যে, আলী রা. কিসাসের ব্যাপারে টালবাহানা করছেন। তারা মক্কায় গিয়ে হযরত আয়েশা রা.-কে বলল, হযরত উসমান রা.-কে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। অথচ কেউ তার হত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছে না। এ কথা শুনে হযরত আয়েশা রা. বড়ই কষ্ট পেলেন এবং হযরত তালহা ও যুবায়ের রা.-কে সাথে নিয়ে নিজেই হযরত উসমান রা.-এর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রওনা হয়ে গেলেন।

হযরত আলী রা. পরস্পরে ঝগড়া-বিবাদ পছন্দ করতেন না। কিন্তু এহেন পরিস্থিতিতে আর কীইবা করার ছিল। একদিকে হত্যকারীরা ছিল তার আয়ত্তের বাইরে। অন্যদিকে হযরত আয়েশা রা. ও অন্যরা হত্যাকারীদের প্রতিশোধ নিতে উৎসাহী ছিলেন।

মোটকথা, উভয়পক্ষের সৈন্যরা বসরার দিকে অগ্রসর হল। বসরা ছিল আরবের সবচেয়ে বড় সেনাছাউনি। উভয় পক্ষ মুখোমুখি হওয়ার পর প্রথমে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হল। যেহেতু উভয় পক্ষেরই নিয়ত সঠিক ছিল এজন্য দ্রুতই বিষয়টির সুরাহা হয়ে গেল। উভয় পক্ষের লোকেরা রাতের বেলা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু সাবায়ীরা মুসলমানদের ঐক্য ও সমঝোতা কীভাবে মেনে নিতে পারে? তাছাড়া তাদের বড় আশঙ্কা ছিল যে, যদি পরস্পর সমঝোতা হয়ে যায় তবে তাদের ক্ষতি হয়ে যাবে। এজন্য তারা সিদ্ধান্ত নিল কোনোক্রমেই যেন সমঝোতা পূর্ণতা না পায়। তাই রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল তখন সাবায়ীরা একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে, তাদের কিছু লোক হযরত আলী, হযরত যুবায়ের, হযরত তালহা, হযরত আয়েশা রা.-এর তাঁবুর আশপাশে অবস্থান নিবে। আর বাকিরা উভয় পক্ষের লোকদের উপর আক্রমণ করবে। যখন চারদিকে শোরগোল শুরু হবে আর হযরত আলী রা. অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইবেন তখন তাকে বলা হবে যে, হযরত আয়েশা রা.-এর সৈন্যরা হামলা করেছে। তেমনিভাবে যখন হযরত আয়েশা রা. কিংবা হযরত তালহা ও যুবায়ের রা. জানতে চাইবেন তখন বলা হবে, হযরত আলী রা.-এর সৈন্যরা আক্রমণ করেছে। এভাবে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বেধে যাবে।

জঙ্গে জামাল

সাবায়ীদের বৈঠকে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হওয়ায় তারা সবাই বেশ সন্তুষ্ট হয় এবং ভোর হওয়ার আগেই তারা উভয় দলের উপর আক্রমণ করে বসে। আলী রা. জানতে চাইলে তারা বলে, হযরত আয়েশা রা.-এর লোকেরা আক্রমণ চালিয়েছে। আর হযরত আয়েশা রা. জানতে চাইলে বলে, হযরত আলী রা.-এর লোকেরা আক্রমণ করেছে। যার ফলাফল এই দাঁড়াল যে, উভয় পক্ষের লোকেরা ক্রোধান্বিত হল এবং সকাল হওয়ার সাথে সাথেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হল। সারাদিন উভয় পক্ষের মাঝে তুমুল লড়াই চলল। অবশেষে যখন শামের নিকটে হযরত আয়েশা রা.-এর উষ্ট্রী মারাত্মক আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তখন সংঘর্ষ শেষ হল। কিন্তু এতক্ষণে প্রায় দশ হাজার মানুষের প্রাণ ঝরে গেল। হযরত তালহা রা. ও হযরত যুবায়ের রা.ও শাহাদত বরণ করলেন।

আমর ইবনে জুরমুযান হযরত যুবায়ের রা.-এর মাথা কেটে আলী রা.-এর সামনে রাখল। সে ভেবেছিল, হয়ত এ কারণে তাকে অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করা হবে। কিন্তু হযরত আলী রা. তা দেখেই কেঁদে উঠলেন এবং বললেন, যুবায়ের-এর হত্যাকারীকে জাহান্নামের সুসংবাদ দিয়ে দাও।

সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পর হযরত আলী রা. হযরত আয়েশা রা.-এর নিকট উপস্থিত হলেন এবং পরস্পরে মীমাংসা করে নিলেন। এরপর হযরত আয়েশা রা. মদীনা অভিমুখে রওনা হলেন। বিদায়ের সময় হযরত আলী রা. নিজে কয়েক মাইল পর্যন্ত সাথে গেলেন এবং হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন রা.-কে নিরাপত্তার জন্য হযরত আয়েশা রা.-এর সাথে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন।

টীকা : উটের আরবী শব্দ হল জামাল। এ কারণে এই যুদ্ধকে জঙ্গে জামাল বলা হয়।

(অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ)