খালেদার কারাদণ্ড, জাতীয় নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলবে

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি)’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। এ রায়ের পর দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, আগামী নির্বাচনে এর কী প্রভাব পড়বে-এসব নিয়ে ছয় বিশিষ্ট নাগরিক যা মনে করেন। খবর সাউথ এশিয়ান মনিটরের।

অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে কারাগারে যাওয়ায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচন আসছে। নির্বাচনটা তো অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সে রকম একটি নির্বাচনের জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বেগম জিয়ার মামলাটা সেই পরিবেশ তৈরির সহায়ক হয়নি।
দেশে কত শত শত কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। সেগুলো নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা বা সাজা হওয়ার কথা কমই শোনা যায়। সে তুলনায় বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, টাকার পরিমাণ বিবেচনায় তেমন বড় নয়।

তবে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন এমন একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নিঃসন্দেহে গুরুতর। কিন্তু সেই মামলার নিষ্পত্তি নির্বাচনের আগেই করে ফেলা অনিবার্য ছিল না। সেটাই জরুরি করে তোলা হলো। এর ফলে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণমূলক যে নির্বাচনের কথা আমরা বলছি, তাও অনিশ্চিত করে ফেলা হলো।

এটা সব সময়ই দেখা গেছে, যে নেতারা কারাগারে যান, তাঁদের প্রতি মানুষের একটু আলাদা সহানুভূতি তৈরি হয়। বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও যে সেটা হবে না, তা তো বলা যায় না। তবে তার পাশাপাশি নির্বাচনের আগের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে, সে বিষয়ে মানুষের মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা তৈরি হলো। একটা শঙ্কাও সৃষ্টি হলো, যা নির্বাচনের আগে এই সময়ে না হলেই ভালো হতো।

নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে
দুর্নীতির মামলায় আদালতের রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়ার ঘটনায় নির্বাচনী রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নির্বাচনের বছরটা রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই সময়ে সব দলেরই এমনভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত, যাতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা না দেয়। ধারাবাহিকতা ব্যাহত হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।

অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনী পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এই বছর অনেক কিছু করণীয় আছে। সেগুলো করা না হলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না-ও হতে পারে। তেমন কিছু হলে রাজনীতিতে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে, যা কাম্য হতে পারে না। তাই নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বের এই সময়টা সতর্কতার সঙ্গে অতিবাহিত করতে হবে।

অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায়ের সময়টি সঠিক হয়নি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য এই সময়টি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য প্রস্তুতি শুরু করার সময়। তেমন একটি নির্বাচনের অনুষ্ঠানের জন্য যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও সময়টি তাৎপর্যপূর্ণ। এই সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তা পুরো নির্বাচনী রাজনীতি ও প্রক্রিয়াকেই এলোমেলো করে দিতে পারে। এ কথা মনে রেখেই অগ্রসর হওয়া দরকার।

বিরোধ আরও প্রকট হবে
দুর্নীতির মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়া দেশের রাজনীতিতে অনেক প্রভাব ফেলবে। বিএনপি নির্বাচন করবে কী করে? খালেদা জিয়া জেলে না গেলেও নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের কোনো সুযোগই তারা পাচ্ছেন না। এবার, আদালতের রায় ও খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানোকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, এ সময়ও তো প্রায় চার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার-আটক করা হয়েছে। সরকার তো তাদের মাঠে নামতেই দিচ্ছে না। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিয়েছেন।

এই অবস্থায় আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে সমঝোতামূলক পরিস্থিতির কোনো আশাই দেখা যায় না। বরং রাজনৈতিক বিরোধ আরও প্রকট হবে, যা গণতন্ত্রের জন্য মোটেই ভালো হবে না। তাই কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। আমরা দেশবাসী যে একটা ভালো নির্বাচন চাই, তা ক্রমান্বয়ে আরও দূরের বিষয় হয়ে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনও মনে হয় একতরফাই হবে। তার ফল হবে কার্যত একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা। সে রকম একদলীয় শাসন কায়েমেরই একটা প্রক্রিয়া চলেছে বলে আমার মনে হচ্ছে।

উচ্চ আদালতে আপিলে খালেদা জিয়া জামিন কিংবা অভিযোগ থেকে মুক্তি পেলেও দুর্নীতির যে দুর্নাম তার হয়েছে, তা থেকে মুক্তি পাবেন না। তার বিরুদ্ধে সেই প্রচার বা অপপ্রচার চলতেই থাকবে। সেটা তাদের জন্য নিশ্চয়ই বিব্রতকর হবে। এর ফলে নির্বাচনী মাঠে তাঁদের অনেক সমস্যায় পড়তে হবে।

ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থাকছে
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার রায় রাজনীতিতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাতে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিঃশঙ্ক হওয়া যায় না। এই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া এবং রায়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়েছে। অনাস্থা গভীরতর হয়েছে। জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও অনেক জটিলতা সৃষ্টি করবে।

অভিযোগ, মামলা, বিচার-এগুলো কোনোটাই অস্বাভাবিক বিষয় নয়। সংবিধান অনুযায়ী আইনের চোখে সবাই সমান। আইন অনুযায়ী যে কারও বিচার ও শাস্তি হতেই পারে। কিন্তু সেটা শুধু শাস্তি দেওয়ার জন্য বিচার হিসেবে জনমনে প্রতিভাত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ মামলার বিচার অনেকটা সেভাবেই প্রতিভাত হয়েছে।

বিচারটা এমনভাবে রাজনৈতিকীকরণ হয়েছে, যেন বিচারের পক্ষ রাষ্ট্র বনাম খালেদা জিয়া নন, আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি। এই মামলা নিয়ে দুই দলের পক্ষ থেকেই এত কথা বলা হয়েছে ও হচ্ছে যে মানুষ বুঝতেই পারছে না, খালেদা জিয়া প্রকৃতই অপরাধ করে জেলে গেলেন কি না। জনমনে এ রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে সমাজের ক্ষতি হয়। দুর্বৃত্তরা তার সুযোগ নেয়। মানুষ তখন রাজনীতিবিমুখ হতে থাকে।

এ রকম পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে স্বচ্ছতা থাকে না। রাজনৈতিক অঙ্গনে পারস্পরিক অনাস্থা ও দূরত্ব বাড়তে থাকে। খালেদা জিয়ার বিচারের মধ্য দিয়ে এর সবই ঘটেছে। ফলে রায়ের দিন বড় কোনো সংঘাত না হলেও ভবিষ্যতে হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কাজেই সরকারসহ সবাইকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

অনাস্থা ও দূরত্ব আরও বাড়বে
খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পারস্পরিক অনাস্থা ও দূরত্ব আরও বাড়বে। আদালতের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমার কোনো মন্তব্য নেই। একটা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত এসেছে। এরপর উচ্চতর আদালতে আরও আইনি প্রক্রিয়া চলবে, যার মাধ্যমে একসময় বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে।

কিন্তু কথা হলো, সামনে নির্বাচন। বিএনপি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। তাদের তো নির্বাচনে আসতে হবে। আসতে হলে তার প্রস্তুতি হিসেবে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটা সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রতি সরকার মোটামুটি মারমুখী অবস্থানেই আছে বলে প্রতীয়মান হয়। এবার খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করেও মোটামুটি নির্বিচারেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বিএনপি যে দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছে না, এটা রাজনৈতিক অঙ্গনের একটা বড় সমস্যা। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু করতে হলে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই নির্বাচনে আসতে হবে। নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তার প্রস্তুতি হিসেবে তাদের দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম, সভা-সমাবেশ, মিছিল প্রভৃতি করতে হবে। এগুলো করার সুযোগ তাদের দিতে হবে। জোর প্রয়োগ করে তাদের এগুলো থেকে নিবৃত্ত রাখা উচিত নয়।

একইভাবে বিএনপিরও উচিত নয় কোনো হঠকারী কার্যক্রম চালিয়ে সরকারকে দমন-পীড়ন চালানোর সুযোগ করে দেওয়া।

অস্থিতিশীলতা থেকে যাবে
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে জেলে যাওয়ায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায়, দেশের প্রধান দুই দলকে ঘিরে রাজনীতিতে যে অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান, ভবিষ্যতেও হয়তো তা থেকেই যাবে।

খালেদা জিয়া জেলে গেছেন একটি মামলার আসামি হিসেবে, মামলা লড়ে। এটা যেকোনো রাজনীতিকের ক্ষেত্রেই হতে পারে। তার বিচারের সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়নি। সেগুলো শেষ হতে আরও অনেক সময় লাগবে। কিন্তু বছরটি নির্বাচনের। তাই নির্বাচনের আগে যদি এই প্রক্রিয়া শেষ না হয়, তাহলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, কিংবা নিলেও কীভাবে নেবে, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়।

দেশের প্রধান দুটি দল-আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ না নেয় বা অংশ নিতে না পারে, তাহলে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। কারণ, দেশে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারে না। সর্বত্র একটি দলের প্রাধান্য থাকলে তাকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ‘হাইব্রিড গণতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। আমাদের দেশে এখন যেমন একটি দলের প্রাধান্য এবং নামমাত্র বিরোধী দল রয়েছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি না এলে তেমনই থাকবে বলে ধারণা করা যায়।

দীর্ঘদিন এই ধারা চলতে থাকলে দেশ নামমাত্র গণতান্ত্রিক শাসনের অধীন হয়ে পড়তে পারে। তবে উচ্চতর আদালতে খালেদা জিয়ার মামলার অবশিষ্ট কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না যে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না।