হলি আর্টিজানে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা
গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার এক বছর পূর্ণ হওয়ায় সেখানে জঙ্গিদের হাতে নিহত দেশি-বিদেশিদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। গতকাল শনিবার সকাল থেকে গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের এ রেস্তোরাঁয় নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বিদেশি কূটনীতিক, উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও নিহতদের পরিবারের স্বজনসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এক বছর আগে যে স্থানে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছিলেন ২২ জন, গুলশানের সেই ভবনে ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হল তাদের।
সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবে ও দেশটির আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর মিকিও হাতায়েদা ওই ভবনে গিয়ে ফুল দিয়ে স্মরণ করেন নিহতদের। সকাল ১১টার দিকে ফুল দিতে যান ঢাকায় ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমাসহ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। ফুল দেয়ার পর একটি শোকবাণী পাঠ করেন ইতালি দূতাবাসের কর্মকর্তা। এসময় কয়েকজন কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। ফুল দিয়ে পুলিশ পাহারায় তারা চলে যান। জঙ্গি হামলায় নিহতদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন বিদেশি; তার মধ্যে নয়জন ছিলেন ইতালির, সাতজন ছিলেন জাপানি। নিহত জাপানিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছিলেন। সকালে সাংবাদিকদের হলি আর্টিজানের ফটকের সামনে যেতে দেয়া না হলেও পরে সেখানে তাদের ঢুকতে দেয়া হয়। এর কারণ ব্যাখ্যা করে ডিএমপির উপকমিশনার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, বিদেশিদের অনুরোধ ছিল, তাদের ছবি তোলা যাবে না। সকাল ১১টার আগে শ্রদ্ধা মঞ্চে ফুল দেয়া হয় বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত আইজি মোখলেছুর রহমানের নেতৃত্বে। সেদিন হামলা ঠেকাতে গিয়ে এখানে নিহত হয়েছিলেন পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও পরিদর্শক সালাউদ্দিন। পুলিশ কর্মকর্তা মোখলেছুর গুলশান হামলার ঘটনাটিকে একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ উল্লেখ করে সাংবাদিকদের বলেন, সে ঘটনার পর জঙ্গিবাদের যে ব্যাপকতা দেখা গিয়েছিল, তা মোকাবেলা করতে পেরেছি। আমরা এমন ঘটনার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। আমরা সেদিন তাৎক্ষণিকভাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিজেদের রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে সে ঘটনার মোকাবেলা করেছিলাম। সকাল ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হলি আর্টিজানে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শ্রদ্ধা জানানো শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিবাদ পুরোপুরিভাবে নির্মূল হয়নি, দুর্বল হয়েছে। শুধু ফোর্সের (আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) উপর নির্ভর করলে চলবে না। দেশপ্রেমিক জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। সকাল ১১টার পর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে দলটির একটি প্রতিনিধি দল শ্রদ্ধামঞ্চে ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ইতিহাস বন্ধুত্বের। সেই জায়গা থেকে কখনও ভাবিনি বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এ ঘটনা আমাদের বিপুলভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সরকারের নানামুখী ভূমিকা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের  পথ রুখবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ফুল দেয়ার পর একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সাংবাদিকদের বলেন, যারা এই জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত তাদের দর্শন কোনো সাধারণ দর্শন নয়। শ্রদ্ধা জানান সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, সেলিম রেজা নূর, আসিফ মুনীর, শমী কায়সার। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা আজ ব্যথিত, মর্মাহত ও একইসঙ্গে ক্ষুব্ধ। ধর্মের নামে সেদিন মানুষ হত্যা করা হয়েছে। এখন সরকারের একটি সুচিন্তিত কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের অপশক্তিতে মোকাবেলায় জনতা ও রাজনীতির এক সম্মিলিত রাজনৈতিক ঐক্য দরকার।
হলি আর্টিজানের অন্যতম মালিক সাদাত মেহেদী জানান, এক বছর আগে এদিন এখানে অনেক দেশি-বিদেশি মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের স্বজনেরা শ্রদ্ধা জানাতে আসবেন। মূলত এ বিষয়টি মাথায় রেখে চার ঘণ্টা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমনকি বাড়িটির সামনে সাদা কাপড়ে মোড়ানো লম্বা আকৃতির একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এদিকে হলি আর্টিজানের বর্ষপূর্তিতে শ্রদ্ধা জানাতে ইতালি সরকারের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছে। ইতালি দূতাবাস এবং বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে হবে ওই স্মরণ অনুষ্ঠান। জাপানের সাত নাগরিকের স্মরণে শোকসভার আয়োজন করছে জাপান দূতাবাস ও বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উল্লেখ্য, গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে নিহত হয় তিন বাংলাদেশি নাগরিকসহ ২০ জন। অন্যদের মধ্যে ৯ জন ইতালির, ৭ জন জাপানের এবং একজন ভারতীয়। এছাড়া জঙ্গিদের হামলার শুরুতেই  তাদের আক্রমণে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। রেস্তোরাঁর ভেতরে রাতভর জিম্মি ছিলেন অন্তত ২৫ জন, যাদের প্রায় ১১ ঘণ্টা পর পরদিন সকালে সেনা কমান্ডো পরিচালিত অপারেশন থান্ডারবোল্টের সময় উদ্ধার করা হয়। এছাড়া রাতের বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয় আরও অন্তত ৭ জনকে। অপারেশন থান্ডারবোল্টের পর রেস্তোরাঁ থেকে ৫ জঙ্গিসহ ৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া পালাতে গিয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক রেস্তোরাঁকর্মী। এ ঘটনায় গুলশান থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তদন্ত করছে।