রোহিঙ্গাদের কান্নার ঢেউ টেকনাফে

আমার ছয় ছেলের মধ্যে তিন জনকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আবুইয়া নামের এক নাতিকে চোখের সামনে গলাকেটে হত্যা করেছে তারা। এতে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। কোনও উপায় না দেখে এক নাতির সহায়তায় এইখানে (নো-ম্যানস ল্যান্ডে) আসি। আশির দশকে মিয়ানমার জান্তা সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন দেখেছি। নব্বই দশকের বর্বরতাও দেখেছি। কিন্তু এবারের মতো এত ভয়াবহ বর্বরতা আগে কখনও দেখিনি। গত তিন দিন ধরে রাখাইন রাজ্যে যেভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, এতে মনে হয় রাখাইন রাজ্য মরুভূমিতে পরিণত হবে।’ হাউমাউ করে কান্না জড়িত কণ্ঠে একথাগুলো বলেছেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে জলপাইতলীর নো-ম্যানস ল্যান্ডে থাকা ৭০ বছর বয়সী রশিদ আহমদ। অন্যদিকে, ঢেঁকিবনিয়ার মিয়ারপাড়া গ্রামের একটি ফোরকানিয়া মাদরাসায় শিক্ষক জুনায়েদ আহমদকে আটক করে গত সোমবার তার সামনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় মাদরাসাটি । অসহায় রোহিঙ্গা ববর্রময় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে জীবন নিয়ে কৌশলে পালিয়ে ধামনখালী সীমান্ত দিয়ে আসেন বাংলাদেশে । এটি বাংলাদেশের সীমান্তে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গার জীবনের করুন গল্প। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, এখনো চলছে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনীর তান্ডব। প্রতিদিন জ্বলছে আগুন, ফাটছে বোমা, ঝরছে রক্ত, পোকামাকড়ের মতো মরছে মানুষ। যাকে যেভাবে পাচ্ছে হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে। চলছে গণধর্ষণ। হেলিক্প্টার থেকে শত শত রাউন্ড মর্টার ও গুলি বর্ষণও করা হচ্ছে। নিহতদের শোকে বাকরুদ্ধ আত্মীয়স্বজন। চারদিকে কান্নার শব্দ। স্বজনের লাশ পেছনে ফেলে রুদ্ধশ্বাসে পালাচ্ছে মানুষ। আবার পালাতে চেষ্টা করা হলে পিছন থেকে করা হচ্ছে গুলি। যারা গোলাগুলির শিকার হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই নারী ও মায়ের কোলের শিশু। মায়ের কোল থেকে শিশু ছুড়ে ফেলা হচ্ছে জ্বলন্ত আগুনে। পদদলিত করে দুই দিনের শিশু খুন করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না তারা। এইসব রোহিঙ্গার বেঁচে থাকার স্বপ্ন দিন দিন ফুরিয়ে আসছে। নির্বিচারে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারীধর্ষণ, লুন্ঠনের শিকার হয়ে জীবন বাঁচাতে সহায় সম্পত্তি ফেলে মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজছে সহায়হীন অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এ কারণে রাখাইন রাজ্য থেকে আজও পালিয়ে আসছে হাজার মানুষ। রোহিঙ্গারা বলছেন, যুদ্ধ নয় গণহত্যার নতুন অধ্যায় শুরু করেছে সে দেশের সরকারি বাহিনী। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ও রাখাইন স¤প্রদায়। এইসব বাহিনী এবারে একচেটিয়াভাবে রোহিঙ্গাদেরকে গণহত্যা করে রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধদের পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করছে উদ্যোগ নিয়েছে। হাজার বছরের রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাসকে ধুলোয় মুছে দিতে গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী কাজ করছে জাতিসঙ্ঘের আহ্বানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চালাচ্ছে নির্যাতন।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য নিয়ে ডেস্ক রিপোর্ট
শামসুল হক শারেক, কক্সবাজার থেকে জানায়, আরাকান জুড়ে এখন যেন এক অগ্নিকুন্ড। খুন, ধর্ষণ ও ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ায় রোহিঙ্গারা না পারছে সেখানে প্রাণ বাঁচাতে আর না পারছে সীমান্তে বাধার কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে। রোহিঙ্গারা এখন উভয় সঙ্কটে। গত বৃহষ্পতিবার থেকে আরাকান জুড়ে গণহত্যা শুরু করেছে মিয়ানমার সেনা বাহিনী। এই সময়ের মধ্যে সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নারী-শিশু-পুরুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে খবর পাওয়াগেছে। শত শত ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে গোটা আরাকানকে করা হয়েছে এক বিরান ভূমি।
ইতোমধ্যে এই বর্বরতা নাড়া দিয়েছে বিশ্ববিবেক। এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ, জাতিসঙ্ঘ এবং ইরান। দাবী জানানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন বন্ধের এবং তাদের আশ্রয় ও মানবিক সাহায্য দেয়ার। বাংলাদেশ আরো একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে সন্ত্রাস দমনে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছে। মিয়ানমার এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে বহু রোহিঙ্গার জীবন রক্ষা হবে। কিন্তু মিয়ানমার সেই প্রস্তাব কখনো গ্রহণ করবে এমন কোন আলামত দেখা যাচ্ছেনা। এতে বুঝাযাচ্ছে মিয়ানমারের উদ্দেশ্য সন্ত্রাস দমনের নামে রোহিঙ্গা জাতিসত্বানিধন তথা রোহিঙ্গাদের আরাকানের মাটি থেকে উৎখাত করা। যৌথ অভিযানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থাকলে যেমন বেসামরিক মানুষ ও জান মালের ব্যাপক ধ্বংস সাধন সম্ভব হবেনা তেমনি রোহিঙ্গা গণহত্যার সাক্ষী থাকবে।
গত কয়েকদিনে দশ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা বিজিবির নজরদারী ফাকিঁ দিয়ে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে বলে জানাগেছে। আরো কমপক্ষে বিশ হাজার রোহিঙ্গা নারী-–শিশু-পুরুষ সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অর্ধাহারে অনাহারে খোলা আকাশের নীচে অপেক্ষা করছে। বিভিন্নভাবে আহত এসব রোহিঙ্গাদের মাঝে ব্যাপকভাবে খাদ্যাভাব ও ওষুধের অভাব দেখা দিয়েছে।
এদিকে গুলিবিদ্ধ ৭জন রোহিঙ্গা এপর্যন্ত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছে। মিয়ানমারে এপর্যন্ত এক হাজারের অধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার সেনা-পুলিশ ও মগদের হাতে নিহত হবার খবর জাগেছেন।
পশ্চিম ও উত্তর আরাকানের গ্রাম গুলো অগ্নি সংযোগ কালে পলিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের গুলি ও মটার শেল নিক্ষেপ করলে এসব গুলা বাংলাদেশ সীমান্তে আঘাত করে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এতে করে বাংলাদেশ সীমান্তে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সীমান্ত এলাকার সব স্কুল, মাদরাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকার মসজিদ গুলোতেও মুসল্লি যাতায়াত কমেগেছে। মানুষের স্বাভাবিক যাতায়তে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানাগেছে।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোসহ যে কোন ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবি প্রস্তুত রয়েছে। নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে মিয়ানমার পুলিশ বিজিপি’র সদস্যরা টেকনাফ সেন্টমার্টিন যাতায়াতকারী নৌযান গুলোতে তল্লাশী করছে বলে জানিয়েছেন যাতায়াতকারীরা। এভাবে বাংলাদেশ ভূখন্ডে ঢুকে নৌযান গুলোতে বিজিপির তল্লাশী চালানোর মত ষ্পর্ধা দেখানো আতঙ্কজনক বলেই মনে করছেন সচেতনমহল। সেন্টমার্টিনদ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুর আহমদ জানান, টেকনাফ-সেন্টমার্টিনদ্বীপ নৌপথে চলাচলকারী ১৮টি যাত্রীবাহী ট্রলার রয়েছে। ট্রলারগুলো প্রতি দিনই টেকনাফ-সেন্টমার্টিনদ্বীপ নৌপথে চলাচল করে। মাঝ পথে বিজিপির তল্লাশীর কারণে সেন্টমার্টিনদ্বীপের বাসিন্দাগণের মধ্যে আতংক দেখা দিয়েছে।
উখিয়ার পালংখালী ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোজাফফর আহমদ বলেন, নাফ নদী পার হয়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নদীর পারে অবস্থান করছে। ওপারে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি। শুধু তাই নয় শোনা যাচ্ছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের কান্নার আওয়াজ। রোববার সন্ধ্যার পর থেকেই থেমে থেমে গুলির শব্দ এবং আগুনের শিখাও দেখা যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এক তরুণীসহ আরও ৫ জনকে। এরা সবাই সেনা অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এ নিয়ে গত ৪ দিনে আহত ২১ রোহিঙ্গাকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। সোমবার গভীর রাতে খালেদা আকতার (১৭) ও মামুনুর রশিদ (১৯) নামে দুইজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চমেক হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দীন জানান, খালেদা আকতার মংডুর তুমব্রু এলাকার নুরুল ইসলামের মেয়ে। মামুনুর রশিদ ডাংশার নেমাই এলাকার আবদুর রশিদের ছেলে।
চিকিৎসকেরা জানান, এ দু’জনের শরীরে বুলেটের আঘাতের পাশাপাশি আগুনে পোড়ার চিহ্নও রয়েছে। তার আগে গুলিবিদ্ধ আরও ৩ জনকে হাসপাতালে আনা হয়। তারা হলো- মংডু থানার দিয়াতলী এলাকার মোঃ আলীর ছেলে জোনায়েদ (১৫), একই এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে জয়নাত উল্লাহ ও হোসেন আহমদের ছেলে খালেদ হোসেন (২৭)। এরা সবাই গুলিবিদ্ধ। আহত ও তাদের স্বজনরা জানান, সেনাবাহিনীর অভিযানে রোহিঙ্গা বসতিতে নির্বিচারে গুলির পাশাপাশি অগ্নিসংযোগও করা হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন অনেকে।
বৃহস্পতিবার রাতে রাখাইনে একসঙ্গে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলার পর রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। ওই রাতের হামলার জের ধরে এ পর্যন্ত কয়েকশ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। সেনা অভিযানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়িঘর নির্বিচারে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘরবাড়ি ছাড়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তের পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। যারা বাংলাদেশে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে তাদের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও আহতদের পাঠানো হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতাল থেকে বরাদ্দকৃত ওষুধের বাইরে যেসব ওষুধ প্রয়োজন তা কিনতে পারছেনা হতভাগ্য রোহিঙ্গারা। এতে করে তাদের চিকিৎসাও বিঘিœত হচ্ছে। কয়েকজনকে পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাদের সাথে কোন আত্মীয় স্বজন নেই। যাদের আত্মীয় স্বজন আছে তাদেরও ওষুধ কেনার মতো কোন টাকা-পয়সা নেই।
গুলিবিদ্ধরা হলেন- মামুনুর রশিদ (২৭), সাকের (২৭), সাদেক (২০), জাহেদ (২০), নুরুল আলম (১৫), আবুল কাসেম (২০) ও নুরুল আমিনকে (২২)। রাত ২টার দিকে তাদের হাসপাতালে আনা হয়। রোববার সকালে চমেকে আনা হয় আরও চার রোহিঙ্গাকে। তারা হলেন-জিয়াবুল (২৭), মো. ইলিয়াছ (২০), মো. তোহা (১৬) ও মোবারক হোসেন (২৫)। তারও আগে আনা হয় গুলিবিদ্ধ তিনজনকে। এর মধ্যে একজন মারা যান। আহতদের কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য চমেকে নিয়ে আসা হয়। তাদের কক্সবাজার জেলা পুলিশের পাহারায় রাখা হয়েছে।