ভাবনা সবার নির্বাচন
বদলে যাচ্ছে দেশ; বদলে যাচ্ছে রাজনীতির চালচিত্র। জুলুম-নির্যাতন ও সংঘাত-সংঘর্ষের বদলে বাতাসে ভাসছে নির্বাচনের গন্ধ। মাঠের বিরোধী দলকে ঠেঙ্গানোর বদলে নিজেরাই ভোটের প্রস্তুতিতে ঘর গোছানোর পাশাপাশি ইসলামী চিন্তাচেতনার ভোটারদের ভোট নৌকায় উঠানোর চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিও পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোটের দৌড়ে সামিল হতে এরশাদ জোট গঠনের ঘোষণা দিলেও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ কার্যত নিষ্প্রভ। তার মতোই নিষ্প্রভ বর্তমান সংসদের দেড় শতাধিক এমপি। ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে তারা সংসদে গেলেও প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন না করার ঘোষণায় আগামী ভোটে সে ধরনের সম্ভাবনা দেখছেন না। ‘এমপিত্বের আমলনামা’ খারাপ হওয়ায় সারাদেশের শোয়া শ’ থেকে দেড়শ এমপির দলীয় নমিনেশন পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সভা সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সে ইংগিত দিচ্ছেন। নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে তাদের মধ্যে ততই বাড়ছে হতাশা। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, বর্তমান সংসদ কোনো ক্রিয়াকর্ম করছে না। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের যে দায়িত্ব তারা সেটা না করায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার জরুরী হয়ে পড়েছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুনসেফ আলী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের প্রস্তুতির সময়ই ইসির উচিত নেবেল প্লেইং ফিন্ড গঠনে মনোযোগ দেয়া। যদিও পুরোপুরি সেটা সম্ভব নয়; তারপরও চেস্টা করতেই হবে। পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, পাকিস্তানী কায়দায় ‘কম গণতন্ত্র অধিক উন্নয়ন’ থিউরি দিয়ে আমলাদের হাতে গণতন্ত্রের দায়িত্ব দেয়ায় ফেয়ার নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়। হায়দার আকবর খান রনো বলেন, ক্ষমতাসীনরা সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে দেবে এটা বিশ্বাস করা দুস্কর।
আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সালে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যে তিনি সবাইকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন ‘আমি কখনওই চাইব না আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠুক’। তিনি দিল্লী থেকে প্রকাশিত ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আর কোনও ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন চাই না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কার্যত নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে যাচ্ছেন জনগণের কাছে নৌকায় ভোট চাচ্ছেন। নানা দাবি উালেও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী এবং বিশিষ্টজনেরাও গণতন্ত্র বাঁচাতে নির্বাচন ‘অত্যাবশ্যক’ মনে করছেন। তারা বলছেন নির্বাচনকালীণ সরকার কেমন হয় তার উপর সবকিছু নির্ভর করছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। বড় দুই দলের সিনিয়র নেতারা তৃর্ণমূল সফরে গিয়ে নির্বাচনের আগাম প্রস্তুতি, প্রার্থী নির্বাচন এবং দলের ‘বিতর্কিত’ নেতাদের সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। তবে কিছু কিছু নেতা এবং বড় বড় পদধারী নির্বাচন ইস্যুতে অনেকটা উদাস। ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নেয়া এসব এমপি জনগণের মুখোমুখি হবেন এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে পারবেন এমন আস্থা পাচ্ছেন না।
গণতান্ত্রিক দেশ এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন বর্তমান ক্ষমতাসীনদের জন্য জরুরী। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচন জাতিসংঘ, ওআইসিসহ প্রভাবশালী দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছে এখনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্রভাবশারী দেশগুলোর নেতাদের ঢাকা সফর এবং ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের কথাবার্তায় তার প্রকাশ ঘটছে। দেশের সাধারণ মানুষ ভোটের অধিকার হারিয়ে চাপা ক্ষোভে ফুঁসছে। বিশ্বপরিমন্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচন জরুরী। সে জন্যই আওয়ামী লীগ চায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী এবং বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী পালন করতে। যার কারণে রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ ইসলামী ধারার সংগঠন হেফাজতের ভোটের দিকে হাত বাড়িয়েছে। দলটি প্রচার করছে এটা রাজনৈতিক কৌশল। অন্যদিকে নানা বিতর্কের মধ্যেও বিএনপি নানা কারণে পর্যুদস্ত জামায়াতকে ছাড়ছে না। ভোটের প্রস্তুতি নিতে আওয়ামী লীগের নেতা এবং মন্ত্রীরা জেলা সফলে যাচ্ছেন এবং নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। দলের অভ্যন্তরে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার তাগিদ দিয়ে বিতর্কিত নেতাদের বার্তা দিচ্ছেন আগামী নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হওয়া না হওয়া নিয়ে। অন্যদিকে বিএনপির তৃর্ণমূলে ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে সাংগঠনিক পুনর্গঠন, থিঙ্কট্যাংকের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং কূটনীতিসহ সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনার মাধ্যমে দলীয় কৌশল প্রণয়ন করছে। জেলা পর্যায়ে সংগঠনিক কর্মকান্ড দেখভালের লক্ষ্যে অর্ধশতাধিক কমিটি গঠন করেছে দলটি। ওই কমিটিগুলো সাংগঠনিক পুনর্গঠনে কাজ করছে। এসব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের তত্ত¡াবধানে। বিএনপির দায়িত্বশীল সুত্রের মতে ‘নির্বাচনী সহায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের দাবি অব্যাহত রাখলেও যে কোনো প্রক্রিয়ায় হোক আগামী ভোটে দলটি অংশ নেবেই। গতকালও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার এবং নির্বাচনের পরিবেশ থাকলে বিএনপি নির্বাচনের জন্য সব সময় প্রস্তুত। বিএনপিকে নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল হিসেবে অবিহিত করে তিনি বলেছেন, ৩০০ সংসদীয় আসনের বিপরীতে বিএনপির ৯০০ প্রার্থী আছে। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ৭ মে জোটের ঘোষণা দেয়া হবে। তবে ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুশোচনায় এরশাদ বলেছেন, জাতীয় পার্টি কার্যত পরিচিতি ক্রাইসিসে ভুগছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এরশাদ নিজের নের্তৃত্বে জোট গঠনের তৎপর হলেও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ কার্যত হতাশ। তিনি নির্বাচনী এলাকার জনগণ দূরের কথা দলের নেতাকর্মীরাই তার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি প্রসঙ্গে ন্যাপ ঐক্য প্রক্রিয়ার আহবায়ক পঙ্কজ ভট্টচার্য ইনকিলাবকে বলেন, দুনিয়াতে সবচেয়ে অভিনব তত্ত¡ কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ্যের নের্তৃত্বের দাবিদার আওয়ামী লীগ এখন ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’ থিউরি প্রচার করছে। ’৭১ এর আগে পাকিস্তান শাসকরা এটাই চাইতেন। যেখাবে গণতন্ত্রের জন্য দেশ স্বাধীন করলাম, সেখানে কম গণতন্ত্র প্রচারণায় আতঙ্কিত হই। পাকিস্তানের শাসকরা গণতন্ত্রের রশি টেনে ধরে আমলাদের হাতে দেয়। নির্বাচনের আওয়াজ শুনছি কিন্তু নির্বাচনকালীণ সরকার কেমন হয় সেটার ওপর নির্ভর করছে গ্রহণযোগ্যতা। নির্বাচনকালীণ সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থাকলেও ভোটের তিন মাস আগে ও পরে প্রশাসনের মৌলিক বিষয়ে হাত দেবেন না। ফেয়ার ভোট চাইলে ইসির কমিশনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো ইনকিলাবকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সালে নির্বাচন হতেই হবে। মানুষ চায় ফেয়ার এন্ড ফ্রি ইলেকশন। আওয়ামী লীগ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে যা করছে তাতে তারা ফেয়ার নির্বাচন দেবে বিশ্বাস করা কঠিন। ওই সময় তো সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, একটি পৌরসভা এভাবে না জিতলে সমস্যা ছিল না। কাজেই নির্বাচনী আমেজ আছে কিন্তু আগাম কিছু বলা দুস্কর। সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুনসেফ আলী ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যেভাবে প্রচারণা চালাতে পারবেন বিএনপি হয়তো সে ভাবে পারবে না। তাদের অনেকেই মামলার কারণে নির্বাচনও করতে পারবেন না। তবে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন গণতন্ত্রের স্বার্থেই। বর্তমানে বড় দুই দল নির্বাচনী প্রচারণায় নামলেও ‘নিরপেক্ষ ভোট’ হবে কিনা তা নিয়ে স্বংশ্বয় রয়ে গেছে।