বিদায় রমযান, বিদায় ঈদ : কী পেলাম, কী হারালাম

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

রমযান মাস পুরোটাই কল্যাণ ও বরকতের মাস। এই মাস আমাদের উপর মেঘমালার মতো সুশীতল ছায়া দান করছিল, এ মাসের রোযা তাকওয়ার অনুশীলন দান করছিল। মেহরাবগুলোতে হাফেয সাহেবদের সুমধুর তেলাওয়াতের ধ্বনি, যা মূলত মুমিনদের উদ্দেশ্যে রাহমানুর  রাহীমের আহবান, মস্তিষ্ককে সুশোভিত আর অন্তঃকরণকে আলোকিত করছিল, তেলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, যিকির ও দুআ অন্তরকে আল্লাহর নৈকট্যের অনুভূতিতে সিক্ত এবং চোখ থেকে খোদাভীতির অশ্রু ঝরাচ্ছিল।

দেখতে দেখতেই এই ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটল। যেন ইবাদতের সেই বিশেষ রুখ পরিবর্তিত হল এবং ১ শাওয়ালে রোযা নয়, ইসলামী শিক্ষা মোতাবেক ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নির্দেশ এল এবং এরই মাধ্যমে বান্দা তার গোলামির পরিচয় তুলে ধরার নির্দেশ পেল।

শাওয়ালের ২ তারিখ থেকে এক বছরের জন্য এই দুই নেয়ামত রমযান ও ঈদ আমাদের কাছ থেকে চলে গেল। যদি হায়াত পাই আর আল্লাহ তাআলার তাওফীক হয় তাহলে পুরো এক বছর পর আবার এই দু্ই নেয়ামত আমরা ফিরে পাব।

এ পর্যায়ে একজন মুমিনের ভেবে দেখা উচিত যে, রমযান ও ঈদ থেকে সে কী পেল এর কী কী প্রভাব ও ক্রিয়া অন্তর ও মস্তিষ্কে, বোধ ও বিশ্বাসে, কর্ম ও চরিত্রে অবশিষ্ট রইল এবং রমযানের বিদায়ে কী কী খায়ের-বরকত সে হারাল।

এটা বাস্তব যে, যে ব্যক্তি রমযানের হক যত বেশি আদায় করেছে, রমযানের আদবসমূহের প্রতি যত বেশি যত্নবান থেকেছে সে তার কর্মজীবনে রমযান ও ঈদের প্রভাব ও ক্রিয়া ততবেশি অনুভব করবে। আর যে ব্যক্তি ত্রুটি করেছে সে তার ত্রুটির মাত্রানুপাতে প্রভাব ও ক্রিয়াতেও ত্রুটি উপলব্ধি করবে।

রমযানের সবচেয়ে বড় প্রভাব (যদি রোযা রাখা হয়ে থাকে এবং রোযাকে গুনাহমুক্ত রাখা হয়ে থাকে) তাকওয়া, যা বান্দাকে প্রতিমুহূর্তেই রাহনুমায়ি করে, কল্যাণের দিকে আহবান করে, কল্যাণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং অকল্যাণের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে। অকল্যাণ থেকে বিরত থাকার তাগিদ সৃষ্টি করে। তাকওয়ায় পরিপূর্ণ অন্তর নসীহত দ্বারা দ্রুত প্রভাবিত হয় এবং সামান্য সতর্ক করার দ্বারা অমঙ্গলের পথ থেকে ফিরে আসে।

আমরা যদি রমযান ও রোযার পুরো হক আদায় না করে থাকি তাহলে তাকওয়ার সেই বিশেষ স্তর আমাদের অর্জিত হয়নি। তবুও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। কেননা, প্রতিটি মুমিনের অন্তরে সামান্য পরিমাণে হলেও তাকওয়ার স্ফুলিঙ্গ অবশ্যই থাকে। আর রোযার মাধ্যমে তাতে কিছু না কিছু বৃদ্ধি অবশ্যই ঘটে থাকে। এখন যদি তা সযত্নে লালন করা হয় এবং সে মোতাবেক ধীরে ধীরে আমল করা হয় তাহলে এগুণ দৃঢ়তর এবং উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকবে। গুণাবলি ও যোগ্যতাসমূহের এটাই সহজাত নিয়ম এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টিকারী সৎগুণাবলির ব্যাপারে একথা অধিক সত্য এবং অধিক প্রযোজ্য।

আল্লাহ তাআলা হাদীসে কুদসীতে নিজেই ইরশাদ করেছেন, আমার বান্দা আমার প্রতি যেরূপ ধারণা রাখে আমি তার সাথে সেরূপ আচরণ করি এবং বান্দা যখন আমাকে স্মরণ করে আমি তার সঙ্গী হই। যদি সে আমাকে একাকী স্মরণ করে আমিও তাকে একাকী স্মরণ করি। যদি সে আমাকে জামাতে সমবেতভাবে স্মরণ করে আমিও তাকে তাদের চেয়ে উত্তম জামাতে স্মরণ করি। যদি বান্দা আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয় তাহলে আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হই তাহলে আমি তার দিকে চার হাত অগ্রসর হই। আর যদি সে আমার দিকে হেঁটে আসে তাহলে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।-সহীহ মুসলিম ২/৩৪১

এখন যদি অন্তরে কোনো নেক কাজের আগ্রহ সৃষ্টি হয় বা নেক কাজের দিকে অন্তর ধাবিত হয় তাহলে বুঝতে হবে এটি তাকওয়া ও খোদাভীতির প্রভাব। এর কদর করতে হবে এবং কালবিলম্ব না করে এই আগ্রহ মোতাবেক আমল করতে হবে। তেমনিভাবে কোনো গুনাহর ব্যাপারে যাতে আমরা দুর্ভাগ্যবশত লিপ্ত রয়েছি, যদি অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি হয়, তা পরিহার করার তাগাদা যদি অন্তরে উপলব্ধি হয় তাহলে বুঝতে হবে এটা অন্তর্নিহিত তাকওয়া ও খোদাভীতির প্রভাব। এর কদর করা এবং সাথে সাথেই সে গুনাহ পরিত্যাগ করত খাঁটি মনে তাওবা করে নেওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে কালবিলম্ব করা এজন্যও ভয়াবহ যে, দুর্বল তাকওয়ার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং বার বার অন্তরের এরূপ আগ্রহকে কদর না করলে তা আরো দুর্বল হয়ে যায়, যা একজন মুমিন বান্দার জন্যে খুবই দুভার্গ্যের বিষয়।

মোটকথা, তাকওয়ার গুণ যার যতটুকুই অর্জিত হয়েছে তা রক্ষণাবেক্ষণ করা, সযত্নে তা লালন করা করে সেটি আরো শক্তিশালী করাই হবে রমযানের নেয়ামতের যথার্থ হক ও শোকর আদায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে  তাওফীক দান করুন। আমীন।

আল্লাহর যেসব বান্দা রমযানের রোযাও রাখেনি এবং ঈদও ভিনজাতির মতো কেবল অনুষ্ঠান-সর্বস্বরূপেই পালন করেছে, রমযানের শেষ দশক, যা পুরো মাসের রূহ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতময় সময়, একেও যারা ঈদ-মার্কেটের পেছনে ক্ষয় করেছে, তাদের কাছে এখন রমযান ও ঈদের কিছু থেকে থাকলে আছে নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক আর জুতো এবং বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে পাওয়া কিছু গিফট আর ঈদ কার্ড!

তেমনি যারা রমযানে জিনিসপত্রের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে রোযাদারদের থেকে অন্যায়ভাবে অধিক মুনাফা লুটে সম্পদের পাহাড় গড়েছে অথবা বিতাড়িত শয়তানের শৃঙ্খলিত থাকা সত্ত্বেও যারা এই মুবারক মাসে অন্যায়-অপরাধ, দুর্নীতি-সন্ত্রাস ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল-এদের জন্য এখনও পথ খোলা রয়েছে। রাববুল আলামীন অসীম দয়ালু ও মেহেরবান। তাঁর দয়ার দুয়ার সব সময় বান্দার জন্য খোলা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিম্নোক্ত বাণীটি একটু হৃদয়ের কান দিয়ে শুনুন-আল্লাহ তাআলা রাতে তাঁর রহমতের হাত প্রসারিত করেন (বান্দার তাওবা কবুল করার জন্য উন্মুক্ত থাকেন) যাতে দিনের অপরাধী তওবা করে (কৃতকর্মের ব্যাপারে অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে) এবং আল্লাহ তাআলা দিনে তাঁর রহমতের হাত প্রসারিত করেন যাতে রাতের অপরাধী তওবা করে। যত দিন না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হয় (কেয়ামতের আগ পর্যন্ত এ সুযোগ অবারিত)।-সহীহ মুসলিম ২/৩৫৮

তাই কোনো রকম বিলম্ব না করে এই সূবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করা উচিত। খাঁটি মনে তওবা করে কল্যাণের পথে প্রত্যাবর্তন করা উচিত এবং আগামী রমযানের কল্যাণ ও বরকত লাভের জন্য নিজেকে প্রস্ত্তত করা উচিত।

এ ব্যাপারে শেষ কথাটি হল, আমরা রমযান মাসে যেমন আল্লাহর বান্দা ছিলাম এখনও আল্লাহর বান্দা। তাই তখন যেমন গুনাহ পরিহারের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিতাম, নামাযের প্রতি খেয়াল রাখতাম, জামাতের সাথে নামায আদায়ের চেষ্টা করতাম সে ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত রাখা উচিত।

গুনাহ যখনই করা হোক তা গুনাহ। তাই রমযান মাস চলে গেলে গুনাহর কাজে লিপ্ত হওয়া যায় এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে। তাছাড়া নামায তো রোযার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ফরয এবং প্রতি দিনের আমল। ঈমান ও ইসলামের নিদর্শন। যে মুমিন অন্তত এটুকু চিন্তা করবে যে, নামাযের মাধ্যমে মাটি দ্বারা সৃজিত এই দুর্বল মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা ও মালিকের দরবারে হাজিরা দিতে পারছে, তার প্রিয় প্রেমাষ্পদ রহমান ও রহীমের সঙ্গে কথোপকথনে সক্ষম হচ্ছে, তার পক্ষে নামাযের ব্যাপারে কোনো শিথিলতা প্রদর্শন করা সম্ভব হবে না; বরং অতি দুর্লভ অথচ সহজপ্রাপ্তি ভেবে মনেপ্রাণে নামাযের ব্যাপারে যত্নশীল হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করার তাওফীক দান করুন। নামাযের গুরুত্ব বোঝার এবং একে জানদার বানানোর প্রচেষ্টায় আমাদের নিয়োজিত রাখুন। আমীন ইয়া রাববাল আলামীন।