এক নজরে নেপালে ইউ এস বাংলা বিমান দুর্ঘটনা!

 

ঢাকা: সোমবার ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া নেপালগামী ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান নেপালের ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫০ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে ১৭ জন আহত যাত্রীদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছেও বলে জানা গেছে। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনের সূত্রে দিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ খবর জানা যায়।

ইউএস বাংলা বিমানের যাত্রীদের মধ্যে ৩৩ জন নেপালি, ৩২ জন বাংলাদেশি, একজন মালদ্বীপ এবং একজন চীনা নাগরিক ছিলেন। যাত্রীদের মধ্যে দুজন শিশু ছিল বলেও জানা গেছে।

বিমানবন্দরের জেনারেল ম্যানেজার রাজ কুমার ছেত্রী বলেন, বিমানটির ৫৭ আরোহী মারা গেছেন। তবে এ মুহূর্তে হতাহতের সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। তবে নিহত ইউএস-বাংলা বিমানের ক্রুদের নাম জানাগেছে। ক্রুরা হলেন- প্রিথুলা রশীদ, রকিবুল হাসান খাজা হোসাইন ও নাবিলা।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ৭৬ আসন বিশিষ্ট এই বিমানটি সোমবার দুপুর ২.৩০ মিনিটে কাঠমুন্ডু বিমানবন্দরে অবতরণের সময় এ দুর্ঘটনাটি ঘটে।

ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের পূর্ব দিকে ফুটবল খেলার মাঠে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নেপালের সেনাবাহিনীরা উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে বলে জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

এদিকে দেশটির বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সানজিব গৌতম বলেন, রানওয়েতে অবতরণের চেষ্টার সময় বিমানটির পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।

তিনি বলেন, ইউএস-বাংলার বিমানটিকে বিমানবন্দরের দক্ষিণ-প্রান্ত থেকে রানওয়েতে অবতরণের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিমানটি বিমানবন্দরের উত্তর অংশ থেকে অবতরণের চেষ্টা করে। এ সময় হঠাৎ বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। পরে বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।

দুর্ঘটনার কারণে ত্রিভুবন বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে সব ধরনের বিমান ওঠানামা এখন বন্ধ রয়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক আমেরিকার নাগরিক জানিয়েছেন, বিমানটি মাটির খুব কাছে দিয়ে উড়ে আসছিল।

এদিকে এই ঘটনায় ছয় সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করেছে নেপাল।

বিয়েবার্ষিকীর আনন্দ উদযাপন করতে গিয়ে সপরিবারে নিহত হয়েছেন মেহেদী হাসান অমিও ও সোনা মণি নামে এক দম্পতি। ঘটনার পর সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক স্বজন এভাবে তার আহাজারির কথা জানান।

এই দম্পতি তাদের শিশু সন্তানসহ বিয়েবার্ষিকী পালনের জন্য কাঠমান্ডুতে যাচ্ছিলেন। বিমান দুর্ঘটনায় নিহত শিশু দুটির মধ্যে একজন এই দম্পতির বলে ধারণা করা হচ্ছে।এনি প্রিয়ক সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে লিখেছিলেন, Ready to fly to Kathmandu from Hazrat Shahjalal International Airport …Pls keep us on your prayer…। কিন্তু এই হানিমুনে তাদের ভাগ্যে কী ঘোটেছে তা এখনো জানা যায়নি। বিধ্বস্ত বিমানের যাত্রী কবির হোসেনের ছেলে শাওন এসেছেন ইউএস-বাংলা অফিসে বাবার খোঁজ নিতে। তাদের বাড়ি উত্তরখান এলাকায়।

শাওন বলেন, ‘আমার বাবা দুজনকে নিয়ে ব্যবসায়িক কাজে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিমান বিধ্বস্তের পরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে নেপালের স্থানীয় একটি মাধ্যমে জানতে পেরেছি তিনি সেখানকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। তাই এখানে খোঁজ নিতে এসেছি।’

এদিকে বিমানের একটি জানালা ভেঙে লাফিয়ে পড়ে বেঁচে যাওয়া বসন্ত বহরা নামের এক যাত্রী বলেন, ঢাকা থেকে বিমানটি ছাড়ার সময় কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নামার আগমুহূর্তে হঠাৎ করে ঝাঁকুনি দিতে থাকে। এতে যাত্রীরা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আমি জানালার পাশের ছিটে বসা ছিলাম। আমি জানালা ভেঙে বেরিয়ে আসি।

তিনি বলেন, আমি জানালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ার পর আর কিছু বলতে পারি না। কারা যেন আমাকে সিনেমঙ্গল হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে আমার বন্ধুরা সেখান থেকে আমাকে নরভিক হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।

জানা গেছে, বিধ্বস্ত বিমানে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বৈশাখীর স্টাফ রিপোর্টার ফয়সাল আহমেদ ছিলেন। ফ্লাইটের যাত্রীদের তালিকা থেকেই এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে বৈশাখীর হেড অব নিউজ অশোক চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সোমবার থেকে পাঁচদিনের ছুটি নিয়েছিলেন ফয়সাল আহমেদ। তবে তিনি অফিসকে এই সফরের বিষয়ে কিছু জানাননি। পরে ফ্লাইটের যাত্রী তালিকায় নাম দেখে পাসপোর্ট নম্বর মিলিয়ে আমরা বুঝতে পারি ফয়সাল সেই ফ্লাইটে ছিলেন। ফয়সাল বৈশাখীর হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিটের খবর কভার করতেন।

এদিকে ঐ বিমানের যাত্রীদের তালিকা প্রকাশ করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের কর্তৃপক্ষ।

ইউএস বাংলার সূ্ত্রে বিমানের যাত্রীদের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। সেই তালিকায় যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন- রিজনা আব্দুল্লাহ, ফয়সাল আহমেদ, শামরিন আহম্মেদ, ইয়াকুব আলী, আলিফুজ্জামান, আলমুন নাহার অ্যানি, বিলকিস আরা, শিলা বসগেইন, নুরুন্নাহার বেগম, আলজিনা বড়াল, চারু বড়াল, আক্তারা বেগম, শাহীন বেপারী, সোভিন্দ্র বোহারা, বসন্ত বোহারা, সামিরা বাজানকার, প্রবীণ চিত্রকর, নাজিয়া চৌধুরী, সাজেনা দেবকোটা, প্রিন্সি ধামী, গয়োন্ত গ্রুঙ, রেজোয়ানুল হক, রকিবুল হাসান, মেহেদী হাসান, মো. কবির হোসেন, দিনেশ হুমাগাইন, সানজিদা হক, হাসান ইমাম, মো. নজরুল ইসলাম, শ্রেয়া ঝা, পূর্ণিমা লোহানী, মিলি মহারাজন, নিগা মহারাজন, সঞ্জয় মহারাজন, ঝাং মিং, আঁখি মনি, মিনহাজ বিন নাসির, শেখর পান্ডে, প্রসন্ন পান্ডে, বিনোদ রাজ পাডোয়াল, শঙ্করহরি পাডোয়াল, সঞ্জয় পাডোয়াল, এফএইচ প্রতিক, তামারা প্রিয়ন্ময়ী, মতিউর রহমান, শেখ রুবায়াত, কৃষ্ণকুমার শাহানী, উম্মে সালমা, আসেনা শাকিয়া, সানাম শাকিয়া, অঞ্জিলা শ্রেষ্ঠা, সারোনা শ্রেষ্ঠা, সত্য শর্মা, হরিপ্রসাদ সুবেদি, দয়ারাম তাম্রকার, বালকৃষ্ণ থাপা, সেতা থাপা, কিশোর ত্রিপাঠি, অবদেশ কুমার যাদব, অনিরুদ্ধ জামান, নুরুজ্জামান, রফিক জামান।

এদিকে বিমানটিতে সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ১৩জন শিক্ষার্থী রয়েছেন বলে কলেজ সূত্রে জানা গেছে। এরমধ্যে ১১ জন ছাত্রী ও ২ জন ছাত্র।

এদিকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আলাদা শোক বার্তায় সোমবার বিকেলে তারা নিহতের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন।

রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী নিহতদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করেন এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। এছাড়া শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই  বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে।

এক টুইট বার্তায় মোদি লিখেন- কাঠমুন্ডুতে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণহানির ঘটনায় আমি গভীরভাবে শোকাহত। নিহতদের জন্য প্রার্থনা ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি। দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
এক শোক বার্তায় মমতা বলেছেন, এই দুর্ঘটনায় যে সমস্ত মানুষ হতাহত হয়েছেন তাদের পরিবার-পরিজনকে আমার হূদয় থেকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। এই দুঃসময়ে বাংলাদেশ এবং নেপাল সরকারের নেতৃত্ব এবং জনগণের প্রতি জানাই আমার গভীর সহমর্মিতা, সহানুভূতি এই বিমান দুর্ঘটনার ঘটনায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ শোক প্রকাশ করেছেন। এবং কাঠমান্ডুতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ারও আশ্বাস দেন তিনি। একইসাথে এই ‍বিমান দুর্ঘটনায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শোক প্রকাশ করেছেন।

এদিকে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের মরদেহ দেশে আনা ও আহতদের চিকিৎসা বাবদ সকল খরচ ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ বহন করবে। মঙ্গলবার ইউএস-বাংলার জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন।

উল্লেথ্য, নেপালে এমন বিমান দুর্ঘটনা এই প্রথম নয়। বিগত ৭ বছরে ১৫টি ছোট-বড় বিমান দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে নেপালে। নেপালের জরিপ সংস্থা নেপাল ইন ডাটা অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এসব প্লেন ক্রাশের ঘটনায় মোট ১৩৪ জন যাত্রী নিহত হয়েছেন। ওই ৭ বছরের প্রতিবছর কমপক্ষে একটি করে বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।